অনেক মহিলারই গর্ভাবস্থায় বদহজম হয়, যা বেশ কষ্টকর ও অস্বস্তিজনক। বদহজম (বা বুক-জ্বালা) হল কিছু খাওয়া বা পান করার পরে উপরের পেটে হওয়া যন্ত্রণা বা অস্বস্তি, কিন্তু তা কিছুক্ষণ পরেও হতে পারে। বুক-জ্বালার সাথে হৃদপিণ্ডের কোনও সম্পর্ক নেই, তবে অ্যাসিডিক খাবার ও তরল ইসোফেগাসে উঠে গিয়ে আপনার গলায় বা বুকের হাড়ের পিছন দিকে জ্বালা সৃষ্টি করে। ইসোফেগাস হল গলা ও পাকস্থলিকে যুক্ত করার একটি টিউব। এটি হরমোনের পরিবর্তনের ফলে ও বাড়তে থাকা শিশু পেটে চাপ দেওয়ার ফলেও হতে পারে। গর্ভাবস্থায় যে-কোনও সময় বদহজম হতে পারে, তবে গর্ভাবস্থার তৃতীয় ট্রাইমেস্টারে এটি আরও সাংঘাতিক হয়ে যায়। আমাদের ডায়েট ও জীবনযাত্রায় কিছু পরিবর্তন করে এবং গর্ভাবস্থায় কিছু নিরাপদ ওষুধ খেয়ে বদহজম থেকে কিছুটা উপকার পাওয়া যেতে পারে।
বুক-জ্বালা ও বদহজমের লক্ষণ :
আপনার বুক-জ্বালা বা বদহজম হলে আপনার শরীর ভারী লাগবে, মুখের স্বাদ টক হয়ে যাবে, বারবার ঢেকুর উঠবে ও কাশি হবে, আপনার বুক বিশেষত খাওয়ার পরে জ্বালা করবে, বমি হবে, অত্যন্ত মাথা যন্ত্রণা করবে এবং পায়ের পাতা ও হাত হঠাৎ ফুলে যাবে।
বদহজমের কারণ
- সাইট্রাস জাতীয় খাবার যেমন টমেটো, কমলালেবু ও আঙুর এড়িয়ে যান, কারণ এগুলি থেকে বুক-জ্বালা ও বদহজম হতে পারে। পরিমিত পরিমাণে টমেটো খাওয়া উচিত। টমেটো ও টমেটো থেকে তৈরি প্রোডাক্টে ম্যালিক ও সাইট্রিক অ্যাসিড থাকে, যার ফলে পাকস্থলিতে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিড তৈরি হয় এবং গ্যাস্ট্রিক অ্যাসিডের মাত্রা এতটাই বেড়ে যায় যে তা ইসোফেগাসে উঠে আসে। কমলালেবুর রস থেকেও বুক-জ্বালা করতে পারে। এতে অ্যাসকর্বিক অ্যাসিড থাকে, যা প্রচুর পরিমাণে খেলে বদহজম বাড়াতে পারে।
- ক্যাফিন ও সোডা এড়িয়ে চলুন। ক্যাফিন একটি উদ্দীপক, যা আপনার রক্তচাপ ও হৃদস্পন্দন বাড়িয়ে দিতে পারে। গর্ভাবস্থায় যত সময় এগোয় শরীরের পক্ষে ক্যাফিন হজম করা ততই কঠিন হয়, যার ফলে ঘুম হয় না এবং বুক-জ্বালা করে। গর্ভাবস্থায় চিনিযুক্ত পানীয়, যেমন সোডা এড়িয়ে যাওয়া উচিত, কারণ এগুলিতে বিভিন্ন রাসায়নিক ও ক্যালোরি থাকে, যার কোনও পুষ্টিগত উপকারিতা নেই। এটি ভ্রূণের পক্ষেও ক্ষতিকর। সোডায় কার্বনেটেড জল থাকে, যার ফলে রক্তচাপ বেড়ে যায়। সুতরাং, যদি প্রায়ই সোডা খাওয়া হয়, তাহলে মোটা সন্তান ও গর্ভপাত হতে পারে।
- ভাজা ও তেলযুক্ত খাবার খেলে বদহজম হয়, কারণ এগুলি হজম হতে বেশি সময় লাগে। ফলে আপনার পাকস্থলি বেশি পরিমাণে অ্যাসিড তৈরি করে এবং আপনার শরীর ভারী লাগে। তেলযুক্ত খাবারে ক্যালোরির পরিমাণ খুব বেশি হওয়ার ফলে অতিরিক্ত ওজন বৃদ্ধি পায়। অতিরিক্ত স্যাচুরেটেড ফ্যাট খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের পরিমাণ বেড়ে গিয়ে হৃদরোগের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এছাড়া, গবেষণা থেকে জানা গেছে যে তেলযুক্ত খাবার খেলে ত্রুটিযুক্ত সন্তানের জন্মের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
- হরমোনের পরিবর্তন: গর্ভাবস্থার হরমোনগুলি পৌষ্টিক তন্ত্রকে প্রভাবিত করতে পারে। প্রোজেস্টেরন, যা গর্ভাবস্থার হরমোন হিসাবেও পরিচিত, তা পেশির রিল্যাক্সার হিসাবে কাজ করে। বুক-জ্বালা করলে, হরমোনটি পেশিকে আলগা করতে পারে এবং এর ফলে পাকস্থলি ইসোফেগাসের সাথে কাজ করা বন্ধ করে দেয়। এর ফলে পাকস্থলি, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্রে হজমের কাজ ধীর হয়ে যায়। গর্ভাবস্থার প্রথম ট্রাইমেস্টারে ইস্ট্রোজেনের পরিমাণ দ্রুত বেড়ে যাওয়ার ফলে বমি-বমি ভাব দেখা যায়। এছাড়া শিশু যত বড় হয়, জরায়ুর আকার তত বাড়তে থাকে এবং এর ফলে পেটে চাপ পড়ে ও পাকস্থলির অ্যাসিডগুলি উপরে উঠে আসে। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে গলস্টোনের ফলেও বুক-জ্বালা বা বদহজম হতে পারে।
- চকোলেট। খালি পেটে চকোলেট খাবেন না। চকোলেট খাওয়ার পরিমাণ সীমিত রাখুন এবং যদি ডার্ক চকোলেট খান, তাহলে তা আরও বেশি উপকারী, কারণ এটি ভ্রূণে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে দেয়। 2টি কারণে অতিরিক্ত চকোলেট খাবেন না। চকোলেট খেলে খিদে কমে যায়, ফলে আপনার স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া হয়ে ওঠে না এবং আপনার সুষম ডায়েট ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দ্বিতীয়ত, চকোলেটে ক্যাফিন থাকে এবং গর্ভবতী মহিলাদের ক্যাফিন খাওয়ার পরিমাণ কম রাখা উচিত ও প্রতিদিন তা 200 মিলিগ্রামেই সীমিত রাখা উচিত। স্ন্যাক হিসাবে ক্যাফিনযুক্ত পানীয় ও চকোলেট একসাথে খাওয়া একেবারেই ভাল না, কারণ এর ফলে ক্যাফিনের মাত্রা বেশি হয়ে যেতে পারে। এছাড়া, আপনার ব্লাড সুগারের মাত্রা ঠিক না থাকলে, জেস্টেশনাল ডায়াবেটিস থাকলে এবং ওজন বেড়ে গেলে চকোলেট না খাওয়াই উচিত।
- অ্যালকোহল গর্ভাবস্থায় সমস্যা তৈরি করতে পারে। প্রথম ট্রাইমেস্টারে মদ্যপান করলে শিশুর মুখের গঠন অস্বাভাবিক হতে পারে। এছাড়া মদ্যপান করলে হৃদপিণ্ডে সমস্যা, শিশুর জন্মের আগে ও পরে বৃদ্ধিতে সমস্যা, পেশি সঞ্চালনে সমস্যা, গর্ভপাত ও নির্দিষ্ট সময়ের আগে প্রসব হতে পারে।
গর্ভাবস্থায় প্রাকৃতিক উপায়ে বদহজম কীভাবে কমাবেন
কয়েকটি পরামর্শ মেনে চললে অ্যাসিডের উৎপাদনে বাধা দেওয়া যায় এবং বুক-জ্বালার কষ্টও এড়ানো যায়।
- দিনে 3 বার বড় মিল খাওয়ার বদলে সারাদিন অল্প-অল্প করে খেতে থাকুন এবং ধীরে-ধীরে খান
- বুক-জ্বালার ঝুঁকি এড়ানোর জন্য ভাজা, তেলযুক্ত ও মশলাদার খাবার খাবেন না
- খাবার খাওয়ার সময় জল খাবেন না, কারণ এর ফলে অ্যাসিড উপরে উঠে আসতে পারে এবং বুক-জ্বালা করতে পারে। খাওয়া শেষ করার বেশ কয়েক মিনিট পরে জল খেতে পারেন।
- গর্ভাবস্থায় টাইট ফিটিং জামাকাপড় পরবেন না, কারণ এগুলি আপনার পাকস্থলিতে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।
- খাওয়ার পরেই শুয়ে পড়বেন না। খাবার হজম করার জন্য একটু হাঁটাচলা করুন।
- ফাইবারযুক্ত স্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে আপনার ডায়েটকে সুষম রাখুন, কারণ ফাইবার পাচনতন্ত্রকে স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
- শরীরকে সুস্থ রাখতে এবং সুস্থ জীবনযাপন করার জন্য জোরে শ্বাস নেওয়া ও শান্ত থাকা অনুশীলন করুন অথবা প্রতিদিন যোগব্যায়াম করুন।
- গাম বা ক্যান্ডি খাবেন না, কারণ এগুলিতে কৃত্রিম মিষ্টত্ব থাকে, যা আপনার পাকস্থলিতে অ্যাসিডিটি তৈরি করতে পারে।
- খাওয়ার সময় ভালভাবে বসুন। খাওয়ার সময় সোজা হয়ে বসুন, যাতে আপনার পাচনতন্ত্র সহজে কাজ করতে পারে।
- দুশ্চিন্তা করবেন না। কোনও ভাল বই পড়ে বা আপনার বন্ধুদের সাথে সময় কাটিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন।
- মদ্যপান ও ধূমপান করবেন না।
- শুতে যাওয়ার ঠিক আগে কিছু খাবেন না, কারণ এই সময় পাকস্থলির অ্যাসিডগুলি সহজেই উপরে উঠে এসে হজমের সমস্যা তৈরি করতে পারে।
বদহজম এড়ানোর জন্য যে-তরলগুলি খাওয়া যেতে পারে
সহজে খাবার হজম করার জন্য আপনি সারাদিন ধরে কয়েকটি পানীয় খেতে পারেন এবং এগুলি আপনার সন্তানের পক্ষেও উপকারী।
- দুধের পুষ্টিগুণ অনেক এবং এটি মা ও গর্ভে থাকা সন্তানের বিকাশে সাহায্য করে। এটি ক্যালসিয়ামে ভরপুর, ফলে এটি ভ্রূণ এবং মা ও সন্তানের অস্থির বিকাশেও সাহায্য করে।
- গর্ভাবস্থায় ডাবের জল খুবই উপকারী, কারণ এটি কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে, মেটাবলিজম বাড়ায়, পিএইচের মাত্রা ভালভাবে বজায় রাখে এবং হজম ক্ষমতা বাড়ায়। এটি ইলেক্ট্রোলাইটে ভরপুর এবং উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে।
- ভেষজ চা, যেমন গ্রিন টি, আদা-চা ও ক্যামোমাইল টি উপকারী, কারণ এগুলি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়, হজমে সাহায্য করে এবং মর্নিং সিকনেস দূর করে। এগুলি সীমিত পরিমাণে খাওয়া উপকারী।
- গর্ভাবস্থায় ভ্রূণে চারপাশে অ্যামনিওটিক ফ্লুইড তৈরি করায় এবং হজমে করায় জল সাহায্য করে। গর্ভাবস্থায় প্রতিদিন 8 থেকে 12 গ্লাস জল খাওয়া উচিত।
বদহজমের ওষুধ
কিছু সাধারণ ওষুধ বদহজম সারাতে পারে।
- অ্যান্টাসিড, যেমন মাইলান্টা, রোলেইডস ও টামস পাকস্থলির অ্যাসিড পরিবর্তন করে বুক-জ্বালা থেকে আরাম দেয়।
- এইচ2 ব্লকারগুলিও পাকস্থলিতে তৈরি হওয়া অ্যাসিড আটকাতে সাহায্য করে। এগুলি 2-3 ঘণ্টার মধ্যে কাজ করা শুরু করে এবং বেশ কয়েক ঘণ্টা অ্যাসিডের উৎপাদন আটকে রাখে।
- মাঝেমধ্যে বুক জ্বালা করলে পিপিআই (প্রোটন পাম্প ইনহিবিটর) আরাম দেয়। এগুলি তাৎক্ষণিক আরাম দেয় না, তবে 2-3 দিনে এগুলি সম্পূর্ণ কাজ করে।
ওষুধ খাওয়ার আগে সবসময় ডাক্তারের পরামর্শ নিন, কারণ প্রতিটি ওষুধ প্রত্যেকের শরীরে আলাদাভাবে কাজ করে। এগুলির লেবেলে যতদিন ব্যবহার করার কথা লেখা আছে, তার থেকে বেশি দিন ধরে ব্যবহার করবেন না। লক্ষণগুলি থেকে গেলে, আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।
উপসংহার
আমরা জানি যে গর্ভাবস্থায় বদহজম খুবই কষ্টকর ও অস্বস্তিজনক হতে পারে। কিন্তু প্রসবের পরেই এই সমস্যা দূর হয়ে যায় এবং হরমোনের মাত্রাগুলিও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। আপনার বুক-জ্বালার সমস্যা খুব বেশি হলে আপনার ডাক্তারের পরামর্শ নিন।